ট্রাভেল, মনোতৃপ্তির এক বিষয়। শব্দটি এসেছে ফরাসি "থাভায়ি" থেকে। যে সময়টাতে এর প্রচলন শুরু তখন ভ্রমণ তেমন সহজসাধ্য ব্যাপার ছিলোনা। থাভায়ি, ট্রাভাইল বা ট্রাভাইলারের অর্থ দেখলে সে বিষয়ে কিঞ্চিত ধারণা পাওয়া যায়। পৃথিবীতে ভ্রমণকারীরা নানান সময়ে নানান আগ্রহ থেকে ভ্রমণ করেছেন। একটা সময় ভ্রমণের উদ্দেশ্যই ছিলো আবিষ্কার। আঠারো শতকের জেমস কুক কিংবা তারও আগের ভাস্কো দ্যা গামা, সবারই একটি জায়গায় মিল আছে। তারা সবাই পৃথিবী চষেছেন নতুন ভূ-খন্ড আবিষ্কারের উদ্দেশ্যেই। এশিয়ার দক্ষিণদিকের অনেক কাহিনী আমরা জানতে পেরেছি শামস-উদ্-দ্বীনের লেখা থেকে। আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনেও বতুতা বা ইবনে বতুতা কিংবা শামস-উদ্-দ্বীন ছিলেন একজন মুসলিম পর্যটক। চতুর্দশ শতকে জন্ম নেয়া এই ভদ্রলোক সারা জীবন কাটিয়েছেন ভ্রমন করেই। পৃথিবী ভ্রমণের জন্যেই মূলত তিনি বিখ্যাত হয়ে উঠেন। তার লেখা থেকেই আমরা তৎকালীন বাংলাদেশ সম্পর্কে অনেক ধারণা পাই- ‘টানা তেতাল্লিশ রাত সাগরে কাটিয়ে অবশেষে আমরা বাংলাদেশ পৌছালাম। সবুজে ঘেরা বিশাল এক দেশ, প্রচুর চাল পাওয়া যায়। অন্য সব জিনিষও এত সস্তায় পাওয়া যায় সে দেশে যে এরকম আর কোথাও দেখিনি’।

সাগরকন্যায় সূর্যাস্থ

সময়ের পট পরিবর্তনে ভ্রমণে এসেছে পরিবর্তন, পৃথিবী হয়েছে সংক্ষিপ্ত। বছরের পর বছর ভ্রমণ করে একদেশ থেকে অন্যদেশ যাওয়ার বিষয়টি এখন আর নেই। কিন্তু সময় না দিলে কি পাতা পড়ার শব্দ, বিদেশী শিশুর কান্না-হাসির আওয়াজ কিংবা বিচিত্র খাবারের স্বাদ নেয়া সম্ভব? সে কারণেই হয়তো প্রযুক্তির প্রতি আবেগ কেড়ে নেবার অভিযোগ করা হয়। বর্তমান সময়ে ভ্রমণের ভাবার্থ আর উদ্দেশ্য পরিবর্তিত হয়েছে অনেকখানি। ভ্রমণ বলতে অনেকেই বুঝে একটুখানি ছবি তোলা, দু’কয়েক ভিডিয়ো করা বা সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোড়ন। যুগের পরিবর্তনে- উপলব্ধি, আনন্দ আর প্রকাশে পরিবর্তন আসবেই, এতে নেতিবাচকতার কিছু নেই। ভ্রমণের প্রধান উদ্দেশ্য আনন্দ; এতে দ্বিমত হলে সেটিকে আর ভ্রমণ বলা যাবেনা। যদি বলতেই হয় আগে পরে বিশেষণ যোগ করে নিতে হবে।

এবারের গল্পটি কুয়াকাটা যাত্রার। কুয়াকাটা বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের একটি শহরের নাম। আঠারো কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের সমুদ্র সৈকত এ অঞ্চলটিকে করেছে দেশের অন্যতম পর্যটন হাব। এটি বাংলাদেশের একমাত্র সমুদ্র সৈকত যেখান থেকে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত দু’টোই দেখা যায়। কুয়াকাটা ঢাকা থেকে সড়কপথে ৩৮০ কিলোমিটার দূরে এবং বরিশাল থেকে এর দুরত্ব মাত্র ১০৮ কিলোমিটার। এটি পটুয়াখালী জেলা সদর থেকে মাত্র ৭০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত।

আমাদের ভ্রমণ শুরু হয় চট্টগ্রাম থেকে। ভ্রমণের সাপ্তাহ খানেক আগে হঠাৎ কিবরীয়া স্যার ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করেন, কুয়াকাটা যাবো কিনা। হাতে পর্যাপ্ত সময় থাকলে যদি কোথাও ভ্রমণের সুযোগ থাকে; আমি কখনো না বলিনা। স্যারকে সাথে সাথেই জানালাম, যাবো। এক্ষেত্রে ভাবাভাবির কোন ব্যাপার নাই। পেছনের গল্পটি হলো, কুয়াকাটায় উপকূলীয় নদী সম্মেলন ২০২২ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। কিছুদিন আগে সম্পাদিত কার্প ও ডলফিনের জিনোম সিকুয়েন্স সহ সাম্প্রতিক সময়ে হালদার রিমার্কেবল সব সাফল্য নিয়ে আলোচনা করতে হবে এই সম্মেলনে। দুর্দান্ত এক ব্যাপার। এর আগেও আমি গুটিকয়েক সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেছি। তবে এ ব্যাপারটি ভিন্ন। কেননা, এতে আমাদের কাজের সাফল্য নিয়ে আলোচনা হবে। এটি আমাকে বিশেষভাবে উদ্বেলিত করেছে। রুই, কাতলা, মৃগেল, কালিবাউস হালদার বিখ্যাত চার মাছ। এরা হালদাতেই ডিম পাড়ে বছরের একটি সুনির্দিষ্ট সময়। সে ডিম আবার ঐতিহ্যগতভাবে বছরের পর বছর হালদা পাড়ের জনসাধারণ সংগ্রহ করে আসছে। নিজস্ব পদ্ধতিতে তা আবার ফুটিয়ে তারাই বাচ্চা বের করে। ছোটবেলায় মুরগীর ডিম ফুটাতে দেখেছি। গ্রামে বড় হয়েছি বলে গাছের ফাঁকফোকরে বন্য পাখির রেখে যাওয়া ডিম ফোটে বের হওয়া বাচ্চার কিচিরমিচিরও শুনেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে প্রথম জানলাম হালদা পাড়ের এই অভিনব পদ্ধতির কথা। এমন আঞ্চলিক সুগঠিত পদ্ধতি পৃথিবীর আর কোথাও দেখা যায়না। মাছের এই নড়বড়ে ডিম থেকে সম্পূর্ণ নিজেদের পদ্ধতিতে বাচ্চা বের করার কথা প্রথম কার মাথায় আসলো জানা নেই। আমার চোখে তিনি কোন বিজ্ঞানীর চেয়ে কোন অংশে কম নন। আমাদের গবেষণার বিষয় ছিলো এই চার প্রজাতির মাছ আর ডলফিনের হোল জিনোম সিকুয়েন্স বের করা। সহজ ভাষায় পূর্ণাঙ্গ জিনোম রহস্য উদঘাটন। আমরা দু’বছরের অধিক সময় কাজ করে সাফল্যে পৌছেছি। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতিও পেয়েছি। এ উপকূলীয় সম্মেলনে সেসব নিয়েও দু’চারটি কথা হবে। এটি আমার জন্য অত্যন্ত আনন্দের ব্যাপার।

তূর্ণা নিশিতা ট্রেনের এসি স্লিপিং

চট্টগ্রাম থেকে তূর্ণা নিশিতা ট্রেনের এসি স্লিপিং-এ ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম। এই ট্রেনটি রাত এগারোটা নাগাদ চট্টগ্রাম ছাড়ে। আমরাও আমাদের ব্যাগ পত্র নিয়ে এগারোটার আগেই স্টেশনে পৌছে গেলাম। চট্টগ্রামে ঠান্ডার ছিটেফোটাও নাই। শীতকাল, তারপরও খুব কম সময় আমি রাত্রিতে শীতের জামা পরে বের হয়েছি। এখানটায় ওসবের খুব একটা দরকার হয়না। কক্সবাজার শহরেও একই কথা প্রযোজ্য। শীত আসতে না আসতেই এ দু’জাগায় শীত শেষ হতে দেখেছি কয়েক বছর ধরে। সামুদ্রিক উঞ্চ ঢেউয়ের কারণেই এমন হয়ে থাকে। কুয়াকাটা যেহেতু সমুদ্র নগরী, শীতের আহামরি প্রস্তুতি আর নিলাম না। মোটা জ্যাকেটটা রেখেই হাতের কাছের ব্ল্যাজার আর দু’টো গরম কাপড় নিলাম। সম্মেলনের জন্যে দু’তিনটা শার্ট আর কয়েকটা প্যান্ট, একটা লুঙ্গি। ব্যাস! এটুকু নিয়েই ব্যাগটা গুছিয়ে নিয়েছিলাম। ট্রেন ছাড়তে মিনিট পাঁচেক দেরী হলো। খানিকক্ষণ স্যারের সাথে গল্প করেই যে যার বিছনায় ফিরে গেলাম। স্লিপিং-এ এর আগেও আমি যাত্রা করেছি। গতবার কোন এক কারণে সাউন্ড বক্সের সুইচটি নষ্ট ছিলো। যার কারণে প্রতি স্টেশনে এসেই বিকট এলার্মের শব্দে খুব বিরক্ত হয়েছিলাম। এবার সে দুর্ভাগ্যটি আর হয়নি। ট্রেনও চলতে শুরু করলো ধীরে ধীরে। খানিক পরেই ঘুমে আড়ষ্ট হয়ে পড়লাম। যাত্রাপথে ঘুমুতে কখনো অসুবিধে হয়নি আমার। ঘোড়ার মতো দাঁড়িয়ে ঘুমানোরও সুখ্যাতি আছে। ট্রেনের এই ঢপাস ঢপাস শব্দে তেমন একটা অসুবিধে ছিলোনা। কিন্তু তারপরও কিছু সময় পর আবার জেগে উঠলাম। উপলব্ধি করলাম ট্রেনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাটলের মতো দুলছে। রেল লাইনের পাথর কমে গেলে এমনটি হয় বলে শুনেছি। এরপর আর ঘুম হলোনা। সকাল ছয়টার দিকে পৌছে গেলাম ঢাকার কমলাপুরে।

কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন

কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে একটি গাড়িতে চেপে চলে গেলাম বিশ্ববিদ্যালয় গেস্ট হাউজে। উদ্দেশ্য হাত মুখ ধোয়া। এ সময়টায় ঢাকা শহর শান্ত থাকে। গাড়ি ঘোড়ার আনাগোনা তেমন একটা থাকেনা। ঢাকার মানুষের জীবন ঘড়ির কাটার চব্বিশঘন্টার আঠারো ঘন্টায় আটকে থাকে, সকাল ছ’টা আর রাত বারটা- এ দুয়ের আগে আর পরে ঢাকা থাকে শান্ত। আমরা মিনিট পনেরোর মধ্যেই পৌছে গেলাম বিশ্ববিদ্যালয় গেস্ট হাউজে। এ জায়গায় আমি প্রথম এসেছি। শিক্ষার্থীদের জন্য এ গেস্ট হাউজ না। এটি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক এবং অতিথিদের জন্যে বরাদ্ধ। আমি যেহেতু স্যারের সাথে ভ্রমণ করতে বের হয়েছি, এ যাত্রায় আমিও অতিথি হিসেবেই আসলাম। আবাসিক বিল্ডিং এর একটি ফ্ল্যাটের সামনে একটি নামফলক আর ভেতরে সুসজ্জিত কিছু রুম। এক ভদ্রলোক আমাদের উপাচার্যের রুমের পাশের রুমটি বুঝিয়ে দিলেন। পরিস্কার করতে যাবেন এমন সময় স্যার বলে দিলেন সেসবের কোন দরকার নেই, মনে করিয়ে দিলেন আমরা এসেছি অল্প সময়ের জন্যে। মিনিট বিশের পরেই আমরা আবার যাত্রা শুরু করলাম। এবারের গন্তব্য ঢাকা সদরঘাট। ওখান থেকেই লঞ্চে রওনা দিবো বরিশাল।

ঢাকার রাস্তায়

‘বাইরে ফিটফাট, ভেতরে সদরঘাট’ চট্টগ্রামে প্রচলিত একটি কথা। যাদের বাইরে চাকচিক্য ভেতরে গাম্ভীর্য্যের কিছু নেই, তাদেরকে তিরস্কার করতে এ উপমাটি দেয়া হয়। সদরঘাট যে অন্তঃসারশূণ্য এমন ধারণা ছোটবেলা থেকেই জন্ম নিয়েছে। ঢাকা সদরঘাটে আমি এর আগেও অনেক বার এসেছি। এ ঘাট হয়েই আমি ভোলা গিয়েছি, নিঝুম দ্বীপ গিয়েছি। পটুয়াখালির আন্দারমানিক নদীও দেখতে গিয়েছিলাম এ ঘাট হয়ে। সদরঘাট হলো মাছ বাজারের মতো। এখানেও দরদাম করতে হয়। এ জায়গায় চতুর পাবলিকরা শূণ্য জায়গাও বিক্রি করে কড়া দাম দিয়ে। গুটিকয়েক লঞ্চ ছাড়া অধিকাংশেই নেয়া অতিরিক্ত যাত্রী। একশো দেড়শো দু’শো বলে ডাকার শব্দ প্রায়শ শুনতে পাবেন এ জায়গায়। গ্রিন লাইনে আমাদের টিকিট কাটা ছিলো। সে সূত্রে ঠকবাজদের কবলে পড়ার সুযোগ আমাদের ছিলোনা। আমরাও উঠে পড়লাম দ্রুত।

লঞ্চ থেকে নদী

লঞ্চের তৃতীয় তলার একটি রুমে উঠলাম আমরা। সকাল সাড়ে আটটার দিকে যাত্রা শুরু হলো। এক ফাঁকে জাহাজেই সেরে নিলাম সকালের নাস্তাটি। এ জাহাজের কফিটা আমাদের বেশ ভালো লেগেছিলো।

বুড়িগঙ্গা নদী

বুড়িগঙ্গার বুক চিরে এগিয়ে চলছি বরিশালের উদ্দেশ্যে। বাংলাদেশের নদীদূষণের নমুনা দেখতে পথে প্রান্তরে ঘুরার দরকার হয়না। এই ঢাকাতেই থাকে নদী বাঁচাও আন্দোলনের শত লোক, আর দুঃখের কথা হলো, তাদের ঘরের পাশেই দুর্গন্ধময় বুড়িগঙ্গা। যে যেমনটা পেরেছে দখল করেছে। নদী দখল, নদী দূষণ, নদী হত্যা সহ সবকিছুরই চুড়ান্ত উপমা এই বুড়িগঙ্গা। বুড়িগঙ্গা পার কখন করলাম বুঝতে কষ্ট হলোনা। নদীযাত্রায় যখনই বুঝবেন তেলের উৎকট গন্ধ নাকে আসছেনা, বুঝবেন আপনি বুড়িগঙ্গা পার হয়েছেন।

নদী পাড়ের জীবন

নদী পাড়ের জীবন আমাকে বারবার আলোড়িত করে। এ জীবনের সাথে ওতোপ্রোতভাবে নদীর সম্পৃক্ততা দেখা যায়। আমরা চাঁদপুর পেরিয়ে মেঘনার দিয়ে সামনে এগুতে লাগলাম। বিশাল জাহাজটির ঢেউয়ে নদীর ছোট ডিঙ্গিগুলো অদ্ভুতভাবে দোল খায়। এ ঢেউ প্রতিনিয়ত আছড়ে পরে নদী তীরে। সংস্কৃতে একটি সুন্দর লাইন আছে। যার বাংলা করলে দাঁড়ায়, হরিণের মাংসই হরিণের মৃত্যুর জন্যে দায়ী। নদীভাঙনের অনেক কারণের মধ্যে এ ঢেউ কিন্তু একটি!

লঞ্চ চলাচলের প্রতি আগ্রহ সব চাইতে বেশি নদী পাড়ের ছোট বাচ্চাদের। আছড়ে পড়া ঢেউয়ের ছিটকে পড়া জল ধরতে তারা ছোটোছুটি করে। নদী পাড় খুব অদ্ভুত জায়গা। এ পাড় আপনাকে আশ্রয় যেমন দিবে, ঠিক তেমনি ভিটেমাটি শূণ্য করতেও দ্বিধে করবেনা।

বরিশাল

দেড়টার দিকে আমরা বরিশাল পৌছালাম। বরিশাল বাংলাদেশের একটি বিখ্যাত জায়গা। দেশের খাদ্যের যোগানের অনেকখানি অংশই আসে বরিশাল থেকে। কীর্তনখোলা নদীর তীরে অবস্থিত এই নগরীতে এককালে নাকি অনেক বড় বড় শাল গাছ ছিলো। সেই থেকেই নাম হলো বরিশাল। আবার অনেকের মতে বড় লবণ বা বড় লবণের চৌকি থেকে এর নাম হলো বরিশাল (বড়সল্ট)। বরিশাল চমৎকার জায়গা। শের-ই বাংলা এ.কে.ফজলুল হক, বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সহ অনেক বিখ্যাত বিখ্যাত মানুষ জন্মগ্রহণ করেছেন এ জায়গায়। যার কবিতার মাধ্যমে নাটোরের বনলতা সারা বিশ্বে বিখ্যাত হয়েছেন সেই জীবনানন্দ দাশের বাড়িও কিন্তু এই বরিশালে। বরিশালে নেমে আমরা দুপুরের খাবার সেরে নিলাম। সবমিলিয়ে তখন আড়াইটা মতো বাজে। বরিশাল নদী বন্দর থেকে রুপাতলী বাসস্টেশনের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম। বরিশালে গাড়িভাড়া দরদাম করে উঠাই ভালো। দুরত্ব যেমনই হোক, ভাড়া কিন্তু দিতে হয় ড্রাইভারের মর্জিতে। যাহোক, রুপাতলি পৌছে জানতে পারলাম, কুয়াকাটার উদ্দেশ্যে ডিরেক্ট ননস্টপড কোন বাস নাই। স্যার সবদিকে ফোন দিলেন। পরবর্তীতে শুনলাম বরিশাল থেকে কুয়াকাটাতে বিআরটিসি বাস সার্ভিস রয়েছে। গেলাম সেখানটায়। কথা বলে জানতে পারলাম চারটায় তাদের বাস ছাড়বে। তার মানে আরো এক ঘন্টা বসে থাকতে হবে। তাদের সাথে বারংবার কথা বলে নিশ্চিত করলাম বিআরটিসি বাস- ক্লোজ ডোর বাস। তারা কাউন্টার ছাড়া অন্য কোথাও থামবেনা। বাহ বেশ ভালো কথা। গাড়িতে একঘন্টা অতিরিক্ত বিরক্তিকর বাস জার্নি না করে কাউন্টারেই একঘন্টা কাটিয়ে দেয়া শ্রেয়।

বরিশাল-কুয়াকাটা সড়ক

চারটার মিনিট দশেক পর বিআরটিসি বাস কুয়াকাটার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলো। বাসেই উঠেই হতাশ হয়ে পড়লাম। এতো ছোট সিট যে ঠিক মতো বসা যায় না। তার উপর বাসটি- লোকাল। হকার থেকে শুরু করে এমন কেউ নেই যে এ বাসে উঠেনা। সুইপারদের ঝাড়ু দেবার মতো রাস্তায় যত মানুষ পায় সবই তুলে নিলো তারা। বরিশাল থেকে কুয়াকাটা বাসযাত্রা এবারের ভ্রমণের সবথেকে খারাপ অধ্যায়। সাড়ে তিনঘন্টার এই বিরক্তিকর প্রতারণার যাত্রা আমাকে বিআরটিসি বাসে উঠতে বারবার ভাবাবে।

পটুয়াখালী

অবশেষে আমরা পৌছে গেলাম কুয়াকাটায়। পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার মহিপুর থানায় কুয়াকাটা পৌরসভা অবস্থিত। আমরা কুয়াকাটায় পৌছাতে পৌছাতে রাত প্রায় আটটা হয়ে গেলো। নেমেই একটি ভ্যান চেপে হোটেলের উদ্দেশ্যে চললাম। পথেই দেখতে পেলাম রাখাইনদের বাজার।

রাখাইনদের বাজার

এ অঞ্চলের নামের সাথে আরাকানদের এদেশে আগমনের ইতিহাস জড়িত। প্রচলিত আছে, আঠারো শতকে বার্মা থেকে আরাকানরা এই অঞ্চলে পালিয়ে আসে। তখনো এখানটায় কোন আবাস ছিলো না। সেই সাথে উপকূলীয় অঞ্চল হওয়ায় সুপেয় পানির অভাব দেখা দিলো। সে ঘাটতি মেটাতেই তারা অনেক কুপ বা কুয়া খনন করেছিলো। তখন থেকেই এই অঞ্চলের নাম হয়ে যায় কুয়াকাটা!

সমুদ্র যেনো মিশে আছে তাদের প্রাত্যহিক জীবনে

কুয়াকাটা পর্যটকদের কাছে ‘সাগরকন্যা’ হিসেবে পরিচিত। এ অঞ্চলের অধিকাংশ জীবিকা গড়ে উঠেছে এ সাগরকে কেন্দ্র করেই। বাস স্টপেজ থেকে অল্প দুরত্বেই আমাদের হোটেল। এই হোটেলের কনফারেন্স রুমেই হবে ‘উপকূলীয় নদী সম্মেলন’। আমরা আসার পরপরই হোটেলের রুম বুঝিয়ে দেয়া হলো। রাতে খেয়েই তেমন একটা বিলম্ব না করেই ফিরে গেলাম রুমে।

প্রাচীন সমুদ্রগামী পালতোলা জাহাজ

পরদিন সকাল থেকেই শুরু হয়ে গেলো সম্মেলন। বাঘা বাঘা সব বক্তার কথা শুনতে শুনতেই দুপুর গড়িয়ে গেলো। খাওয়াদাওয়া শেষ করে খানিক বিশ্রাম নিয়ে বের হয়ে পড়লাম সমুদ্র দেখতে। কুয়াকাটা কক্সবাজারের মতো উষ্ণ হবে, এ ধারণাটি আমার ভুল ছিলো। গতরাতে টেম্পেরেচার ৯ ডিগ্রির কম ছিলো। সমুদ্রের পাড়ের এক একটি বাতাসের ঝাপটা যেনো এন্টার্কটিকা পার করে আসা। আমি একসাথে দুইটি গরম জামা পড়ে বের হয়েছিলাম বলে তেমন একটা ঠান্ডা লাগেনি।

কুয়াকাটা বাজার

সমুদ্রের খুব ক্ষুদ্র একটি অংশকে পর্যটক অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সীমানার এপার ওপারেও পর্যটক যেতে বাঁধা নেই। হয়তো নিরাপত্তার স্বার্থেই এমন জোনিং। সে বিষয়ে বিষদ কোথাও জানার সুযোগ হলোনা। কুয়াকাটা অঞ্চলে যাতায়তের মাধ্যম হিসেবে মোটরসাইকেল এবং ভ্যানই প্রধান। মোটর সাইকেলের আনাগোনা সৈকতেও দেখা যায়। সমুদ্রে বেড়াতে আসা পর্যটকদের তারা নানা পর্যটন অঞ্চল ঘুরিয়ে দেখায়। তাদের হাতে কোন ক্যাটালগ থাকলে হয়তো ভ্রমণ স্থান গুলো দেখতে কেমন সে বিষয়ে সুস্পষ্ট ধারনা পাওয়া যেতো।

ঘন্টাখানেকের মতো সমুদ্র পাড় ঘুরে আমরা আবার হোটেলে ফিরে গেলাম। সন্ধ্যের পর দ্বিতীয় সেশনটি ছিলো। এই সেশনেই কিবরীয়া স্যার আমাদের সাম্প্রতিক কাজ নিয়ে বললেন, হালদা নদী নিয়ে বললেন। প্রাণবন্ত সেশন শেষে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। আর দুর্দান্ত ব্যাপার হলো, এই অনুষ্ঠানেই আমি পুনরায় কুয়াকাটা গিয়ে দুই রাত থাকার একটি লটারি জিতে যাই। স্থানীয় রাখাইনদের নৃত্যের ছন্দে ছন্দে শেষ হয় উপকূলীয় নদী সম্মেলন।

কুয়াকাটা বাজারে স্থানীয়দের দাবা খেলা

কুয়াকাটা বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় একটি পর্যটনখাত। বাংলাদেশের আর কোথাও সুর্যাস্থ এবং সুর্যোদয় একসাথে দেখা যায়না। এ বিষয়টি খুব স্বাভাবিকভাবেই অনেক পর্যটককে আর্কষণ করবে। তবে কোন একটি পর্যটনখাত জনপ্রিয় করতে হলে দরকার নিরবিচ্ছিন্ন যাতায়ত ব্যবস্থা। বরিশাল থেকে ভালো কোন যাতায়ত ব্যবস্থা না থাকায় কুয়াকাটা ভ্রমণ অনেকের কাছে বর্ণহীন হতে পারে। এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ জরুরী। আর যে ‘কুয়া’ থেকে এই অঞ্চলের নামকরণ করা হলো, সেরকম কোন প্রতীকী কূপকে ব্র্যান্ডিং করে এ অঞ্চলে আরো নতুন পর্যটন স্পট সৃষ্টি করা যেতে পারে। ‘আংশিক সুন্দরবন’ সহ আশেপাশের যে পর্যটন স্থানগুলো রয়েছে, সেসবে যাবার যাতায়ত ব্যবস্থা আরো উন্নত করা যেতে পারে।