জাজিরা যার নাম পালটে হয় নারিকেল জিঞ্জিরা। বলছিলাম, টেকনাফ থেকে ৯ কিলোমিটার দূরের এক দ্বীপের কথা যার প্রথম নামটি দেয়া হয়েছিলো আড়াইশো বছর আগে। পরবর্তীতে, চট্টগ্রামের ডেপুটি কমিশনার মার্টিনের নাম অনুসারে দ্বীপটির নতুন নাম হয় মার্টিন’স আইল্যান্ড। মার্টিন আদতে কোন সাধু সন্নাসী ছিলেন না। বরং, দ্বীপে আসা আধ্যাত্মিক সাধকদের সম্মানার্থে নামের শুরুতে যুক্ত হয় সেইন্ট অংশটি। 

সেন্ট মার্টিন যাওয়ার পথে আপনার সাথে থাকবে এই গাংচিলের দল

বঙ্গোপসাগরের উত্তরপূর্বে এবং কক্সবাজারের দক্ষিণে অবস্থিত সেইন্টমার্টিন বাংলাদেশের ৮ বর্গকিমি এলাকা জুড়ে বিস্তৃত বৈচিত্র্যময় এক দ্বীপের নাম। প্রায় পাঁচ হাজার বছর পূর্বে এই দ্বীপটি ছিল তৎকালীন টেকনাফ উপদ্বীপের বর্ধিত একটি অংশ। কিন্তু ধীরে ধীরে এটি চলে যায় সমুদ্র গর্ভে। প্রায় সারে চারশো বছর আগে বর্তমান সেন্ট মার্টিন দ্বীপের দক্ষিণ পাড়া ফের জেগে উঠে। এরও শতবর্ষ পরে উত্তর পাড়া এবং পরবর্তী শতবর্ষে বাকি অংশের আভির্ভাবের মধ্য দিয়ে সময়ের আবহে সৃষ্টি হয় বর্তমান নারিকেল জিঞ্জিরার।

জাহাজের করিডোরে উপভোগ করতে পারবেন নাফ নদীর সৌন্দর্য্য

উত্তরের উত্তর পাড়া, দক্ষিণের মধ্য ও দক্ষিণপাড়া সংযুক্ত হয়েছে গলাচিপায়। আর দ্বীপের যে অংশটি জোয়ারের সময় আলদা থাকে তার নাম ছেড়া দিয়া। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ মন ভরিয়ে দেয়া এই সেইন্ট মার্টিন এর মত  সমুদ্র সৈকত পৃথিবীতে খুব অল্পই আছে। প্রকৃতি সুন্দরী তার সকল সুন্দর বস্তু দিয়ে তিল তিল সৌন্দর্য আহরণ করে যেন এই দ্বীপকে ভরিয়ে দিয়েছেন। অবশ্যই একে সমুদ্র সৈকতের রাণী বললেও খুব অল্পই বর্ণনা করা হয়।

পৌষের কনকনে শীতে আমাদের যাত্রা

এসব ভাবতে ভাবতেই বছরের শেষে পৌষমাসের কনকনে শীতে ২৮ তারিখ প্রথম প্রহরে শুরু হয় টেকনাফের উদ্দেশ্যে আমাদের পথচলা। ভোর সাড়ে ছয়টায় আমরা পৌছে যাই টেকনাফ জিরো পয়েন্টে। পরপরই সকালের নাস্তা সেরে দলবল নিয়ে ছুটে চলি জাহাজের উদ্দেশ্যে।

এ যেন অনিকেত প্রান্তরেরই এক অন্য রূপান্তর

নাফ নদীর বুক চিড়ে  এগিয়ে যাওয়া জাহাজ, গাঙচিলেদের কোলাহল, ঢেউয়ের আছড়ে পড়া ধ্বনি; মনে হচ্ছিল যেন কোন এক কল্পলোকের যাত্রায় সামিল হয়েছি। নদীর দুই কূলে দুই দেশের মিলন যেন অনিকেত প্রান্তরেরই এক অন্য রূপান্তর।

সেন্টমার্টিনের অন্যতম আকর্ষণ মৃত প্রবাল

উল্লেখ্য, নারিকেল জিঞ্জিরাকে প্রবাল দ্বীপ হিসেবে সম্বোধন করা হলেও আদতে এটি কোন প্রবাল দ্বীপ নয়। বিখ্যাত বিজ্ঞানী ডারউইন তার ইভ্যুলিউশন তথ্য দেয়ার আগে আরেকটি জনপ্রিয় তত্ত্ব দিয়েছিলেন। তার মতানুসারে, "মৃত আগ্নেয়গিরির চারপাশে ধীরে ধীরে- বিভিন্ন কোরাল এবং প্রাণীসমূহ বসতি স্থাপন করে এবং এক পর্যায়ে কলোনি তৈরীর মাধ্যমে বিরাট একটি দ্বীপের উদ্ভব হয় যা মূলত প্রবালদ্বীপ।" কিন্তু সেইন্টমার্টিন দ্বীপে এসবের কিছুই ঘটেনি।

এ যেন এক মায়াবী রাজ্য!

মৃদুমন্দ বাতাস আর জলের কলধ্বনি শুনতে শুনতে এই স্বপ্নের যাত্রার শেষ হয় সেইন্টমার্টিনের তীরে। নারিকেল জিঞ্জিরার বালুকাময় দ্বীপে পা দিতেই শুধু একটি কথাই তখন বারবার মনে পড়ছিল, "স্বার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে!"। যেদিকে চোখ যায় শুধু নীল আর নীল। এই নীলের সাগরে ছোট্ট দ্বীপটা যেন গর্বে সুউচ্চে ঠাই পেয়েছে।

সৌন্দর্য্যই যেন সর্বনাশ সেন্টমার্টিনের!

কিন্তু জেটি থেকে খানিক সামনে এগুতেই মনটা কেমন খারাপ হয়ে উঠলো। জীবনানন্দের সেই সুন্দর কবিতাটির উপমা যেন এ অঞ্চলে আর চলবেনা। হূমায়ুন আহমদের সেই দারুচিনি দ্বীপ যেন ঢাকা কিংবা চট্টগ্রামের কোন এক নিউমার্কেট! সেন্টমার্টিনের আরেক নাম দারুচিনি দ্বীপ। কথিত আছে, আরব বণিকদের দারুচিনি বোজাই করা- একটি জাহাজ ডুবি হয়েছিলো এ দ্বীপের তীরেই। তাছাড়াও তাদের মশলা পারাপারের দীর্ঘ যাত্রার স্নিগ্ধ বিরতির স্থান ছিলো এটি। সমগ্র দ্বীপটিই যেন ছিলো নাঠোরের বনলতা সেন। কিন্তু তা আর রইলো কই?

স্নিগ্ধ সকালে সেন্টমার্টিন

খানিক বিরতি নিয়ে সন্ধ্যেবেলা সবাই মিলে জড়ো হলাম সমুদ্রতীরে। স্ববিস্তর জানলাম এ’কদিনে কিভাবে জানবো এ দ্বীপের নাড়ি নক্ষত্র।

সেন্টমার্টিনে চলছে প্লাংকটন সংগ্রহের কাজ

ফিল্ড ওয়ার্কের আলোচনা
পরপরই শুরু হয় গেলো বালুময় তীরে বিভিন্ন প্রাণীর অনুসন্ধান। নানান রঙের শামুক এবং শতবর্ষের কালছে প্রবাল কুড়িয়ে পাওয়ার অনুভূতি ছিল অনন্য; এ যেন সাত রাজার ধন, এ যেন মণিমুক্তা হিরে জহরত।

লাইফ জ্যাকেটে যাত্রা শুরু ছেড়াদিয়ার উদ্দেশ্যে...

ছেড়াদিয়ার উদ্দেশ্যে আমাদের যাত্রা শুরু হয় দ্বিতীয় দিন। সমুদ্রের নীল জলরাশি, সূর্য্যের ঠিকরে পড়া রোদ আর বিশালকার ঢেউ এক অদ্ভুত নাট্যমঞ্চের সৃষ্টি করেছে। এ সাগরের কোন এক প্রান্তরে আমাদের আলোড়ন, বুকের পাঁজরে বাজি ফোটানো হৃদস্পন্দন; এ গল্প আমাদের খুবই প্রিয়, বলতে চাই কোটি বছর ধরে।

অন্য জায়গার মতো ছেড়াদিয়াতেও আপনাকে স্বাগত জানাবে কেয়া গাছ

উত্তর পাড়া থেকে ছেড়া দিয়া যেতেই ঘন্টাখানের বেশি সময় লাগে। ছেড়াদিয়া সেন্টমার্টিনের সবচাইতে সুন্দর জায়গাগুলোর একটি। ট্রলার থেকে নেমে স্বচ্ছ নিল জল আর ছোটতে থাকা মাছেদের দল দেখতে দেখতেই- ছোট ডিঙিতে পৌছে গেলাম সাগরের তীরে। সাগরের কূলঘেষেই মৃতপ্রবালের স্তুপ। এ হাহাকার সুব্যিনিয়র- আমাদের যেন বারবারই বলছে বাঁচা মরার কথা।

প্রবাল পাথরে তোলে নিতে পারেন ছবি!

ছেড়াদিয়াতে আমাদের প্রথম কাজ ছিলো ছড়িয়ে থাকা প্লাস্টিক এক করে রাখা। এ পৃথিবী আমাদের, এর ভবিষ্য মৃত্যুর দ্বায় আমাদেরকেই নিতে হবে। এ এক কষ্টসাধ্য গুরু দায়িত্ব। প্লাস্টিক পর্ব শেষ করেই আবার নেমে পড়লাম শামুক, কড়ি, প্রবাল দেখার কাজে। বেলা গড়ানোর আগে শুরু হলো ফেরার পালা। এক পক্ষ গেলো ট্রলারেই- অন্য পক্ষ্যের উদ্দেশ্য পদযাত্রা। পায়ে হেটে ছেড়া দিয়া থেকে উত্তর পাড়ায় যাবার যাত্রাটি ছিলো এ ভ্রমণের সবচাইতে রোমাঞ্চকর অধ্যায়।

পায়ে হেটেই পৌছালাম ছেড়াদিয়া থেকে উত্তর পাড়া

যাত্রাপথেই চোখে পড়লো শত শত শামুক, ঝিনুক, কড়ি, চোখে পড়লো নোঙর করা নৌকোদের দল আর কেয়াগাছের ফল।

শামুক, ঝিনুকের সাথে দেখা মিলবে বিশ্রামরত নৌকর দল!

নাহ- আজকের বিকেলে আর কোন কাজ নয়।

সেন্টমার্টিনে আমাদের দ্বিতীয় রাত কাটে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্য দিয়ে। এক পাশে চলতে থাকে বার্বিকিউ এর প্রস্তুতি অন্য পাশে গান, কৌতুক, কবিতা, নাচ। 

সকালের সূর্য স্বাগত জানাবে

কাক ডাকা ভোরে সূর্যোদয় উপভোগের মধ্য দিয়ে শুরু হয় আমাদের তৃতীয় দিন। পুব আকাশে রক্তিম আভা আর মাছেদের সাথে বন্ধুত্ব, এ যেন এক জীবন্ত উপন্যাসের পাতায় পাতায়- আমাদের বিচরণ।

সেন্টমার্টিনে বন্ধুদের সাথে কাটানো সময়

মনির আর আমি

আমাদের সেম্পল সংগ্রহ

রাত্রিবেলায় শুরু হয় মাছের তথ্য সংগ্রহের কাজ

নানান জাতের মাছ দেখতে পাওয়া যায় সেন্টমার্টিনে

সেন্টমার্টিনের নানান স্থানে দেখতে পাওয়া যায় মাছের বাজার

সরাসরি সাগর থেকেই নিয়ে আসা হয় এসব মাছ

অতিরিক্ত মাছ এবং আমাছার স্থান হয় শুটকী পল্লীতে

হরেক রকম মাছের দেখা মিলে সেন্টমার্টিনের শুটকী পল্লীতে

শুটকী বানানোর প্রাথমিক ধাপ মাছ যথাযত পরিস্কার

মাছ আহরণের সাথে জড়িত এ দ্বীপের অধিকাংশ মানুষ

এবার বিদায় বলার পালা। ১২ টার দিকে দুপুরের খাবার শেষ করে সেন্টমার্টিন ছাড়ার উদ্দেশ্যে- আমরা যাত্রা শুরু করি। বিদায় বেলায় সেন্টমার্টিন এবং ছেঁড়া দ্বীপে কাটানো পুরোটা সময় যেন- অবিকল চোখে ভাসছিল। আবার কবে ফিরে আসি এ দ্বীপে কেউ জানিনা। 

সেন্টমার্টিন ভ্রমণে আমাদের সাথে ছিলেন বিভাগের শিক্ষকবৃন্দ

‘পান্ডুলিপি কাছে রেখে ধূসর দীপের কাছে আমি

নিস্তব্ধ ছিলাম ব'সে;

শিশির পড়িতেছিলো ধীরে-ধীরে খ'সে;

নিমের শাখার থেকে একাকীতম কে পাখি নামি

উড়ে গেলো কুয়াশায়, কুয়াশার থেকে দূর-কুয়াশায় আরো।

তাহারি পাখার হাওয়া প্রদীপ নিভায়ে গেলো বুঝি?

অন্ধকার হাৎড়ায়ে ধীরে-ধীরে দেশলাই খুঁজি;

যখন জ্বালিব আলো কার মুখ দেখা যাবে বলিতে কি পারো?

কার মুখ? আমলকী শাখার পিছনে

শিঙের মত বাঁকা নীল চাঁদ একদিন দেখেছিলো তাহা;

এ-ধূসর পান্ডুলিপি একদিন দেখেছিলো, আহা,

সে-মুখ ধূসরতম আজ এই পৃথিবীর মনে।

তবু এই পৃথিবীর সব আলো একদিন নিভে গেলে পরে,

পৃথিবীর সব গল্প একদিন ফুরাবে যখন,

মানুষ র'বে না আর, র'বে শুধু মানুষের স্বপ্ন তখনঃ

সেই মুখ আর আমি র'বো সেই স্বপ্নের ভিতরে।‘


স্বপ্ন- জীবনানন্দ দাশ।