আজ সকালে হঠাৎ একটি বিষয় মনে হওয়াতে মনটা কেমন জানি বিষন্ন হয়ে উঠলো। আমি গতকাল সন্ধ্যেতে বাড়ি পৌছেছি। একটা সময় কক্সবাজার ছিলো বাংলাদেশের অন্যতম পরিস্কার নগরীগুলোর একটি। বর্তমান পরিসংখ্যান দেখে হয়তো সেটি আর প্রতিষ্ঠা করা যাবেনা। তবে এখনো অবধি AQI এর মান সহনীয় অবস্থায় আছে। আজকের রিপোর্টে মান দেখলাম ১২০ এর আশেপাশেই রয়েছে। ঢাকায় আমি একটানা বেশিদিন কখনোই থাকিনি। পড়াশোনা এবং কাজের জন্যে চট্টগ্রাম থাকি। চট্টগ্রামে ধুলোবালির মাত্রা যে কত বেশি তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। রাজধানী ঢাকাতে এর ঢেরবেশি। সে তুলনায় কক্সবাজার এখনো অনেক ভালোই আছে। বাড়ি সী বীচ থেকে খুব একটা দূরে না হওয়াতে একটি সুবিধে হয়েছে; মর্নিং ওয়াকে হাটতে হাটতেই সমুদ্রের পাশে যাওয়া যায়। তারপরও হাটার ইচ্ছে থাকলে জুতো খুলে ভেজা বালিতে হাটা যায়- যতক্ষণ মন চায়। আমার কখনোই সমুদ্রে বিরক্তি আসেনি। কক্সবাজারে বন্ধুবান্ধব আসলে যদি মন্তব্য করে সমুদ্রের পাশে বাড়ি বলে আমার হয়তো তাদের মতো রোমাঞ্চ কাজ করেনা; আমি সাথে সাথে আটকে দিই। পাহাড়, সমুদ্র এবং সর্বোপরি কক্সবাজারের মোহ কোনদিন কাটাতে পারবোনা। কক্সবাজারের সন্ধ্যেবেলায় আকাশে যে বিচিত্র রং এর খেলা দেখা যায় তা কোথাও আর দেখিনি। আমার খুব একটা ঘুরাঘুরির সুযোগ হয়না। তবে, প্রতিটি মুহুর্ত উপভোগের আশ্চর্য ক্ষমতা যে আমার আছে, তা জানি। উপভোগের এই মানদন্ডে কক্সবাজারে কাটানো সময়গুলোকে সবসময় উপরেই রাখবো। কিন্তু গত ক'বছরে কক্সবাজারের রাস্তাঘাটের অবনতি হয়েছে অনেকখানি। চারপাশে ধুলোবালি বেড়েছে আশ্চর্যহারে। মন্দের ভালো হলো- নতুন রাস্তার কাজ চলছে। যদিও সমগ্র রাস্তা খনন করে, বিকল্প ব্যবস্থা না রেখে এমন কর্মযজ্ঞকে স্থানীয় জনগণ কতটা সাধুবাদ জানাচ্ছে তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়। যাহোক, আজকে মন খারাপের বিষয় কিন্তু এটি নয়।


বাড়িতে আসার পরিকল্পনা করেছি কয়েকদিন আগেই। কিন্তু কিছু আটকে থাকা কাজের সুরাহা করতে এ ক'দিন কেটে গেলো। পরিকল্পনার শুরু থেকেই মানসপটে একটি পাখিডাকা সকালের চিত্র ভেসে উঠছিলো। আমাদের বাড়ির সামনেই রয়েছে কক্সবাজারের সবচেয়ে বড় কবরস্থান। রয়েছে হাজার খানেক ফলজ, বনজ গাছের সমারোহ। একটা সময় সকালে উঠেই দেখতাম নানান পাখি হৈচৈ করছে। ছোট করে খোলে রাখা জানলা দিলে দিয়ে ক'বার যে চড়ুই ঢুকে এ ঘর থেকে ও ঘর করেছে তার সঠিক হিসেব মনে নেই। বোকাপাখি কাটঠুকরোকে অসংখ্যবার জানালার কাঁচে নিজের প্রতিবিম্বের সাথে যুদ্ধ করতে দেখেছি। কিন্তু আজ সকাল থেকেই কোন পাখি দেখিনি।

একসময় আমরা গ্রামে ছিলাম। শহর থেকে অল্পদূরেই আমাদের গ্রামের বাড়ি। ছোটবেলার যেটুকু স্মৃতি মনে পড়ে, আমি আবেগ আপ্লূত হই। বাড়ির দক্ষিণ পাশেই ছিলো বিরাট পুকুর। তারই পাশে অবৈজ্ঞানিক ভাবে বেড়ে উঠো কিছু জামগাছ। জামগাছের মগডালে অধিকাংশ সময় বাসা গড়তো সাদা বকের দল। পাশে থাকা মাদার গাছের ফুলের রস খেত অনেক পাখি। তারপাশেই অসংখ্য ডাব গাছ। সময়ে সময়ে বাবুই বাসা গড়তো এসব গাছে। সন্ধ্যেবেলায় রেইনট্রির ফাঁকফোকরে প্যাঁচা দেখতে পেতাম। আমাদের দু'তোলার সিড়িঘরের কার্নিশে বাসা গড়েছিল চড়ুই এর অনেক পরিবার। সেসব দেখেই বাবুই-চড়ই পাল্টাপাল্টি যুদ্ধের কবিতা আওড়াতাম। শীতকালের সকালের ঘুম ভাঙতো পাঁকা আনারসের ঘ্রাণে। কতবার যে ঝুনো নারিকেল ছোলে ছিদ্র করে চিনি ঢুকিয়ে জলন্ত খড়ে ছেড়ে দিয়েছি। কত মজা করে যে সেসব খেতাম, এখনো মনে পড়ে।

সময়ের প্রয়োজনে ব্যস্ততা বেড়েছে। বেড়েছে রডপাথুরে দালান। সময়ের প্রয়োজনে টিকে থাকার সংগ্রাম বেড়েছে অনেকখানি। পৃথিবীতে মানুষের চাহিদা বেড়েছে অসীম পর্যন্ত। এক চকোলেটের কাভার বেড়ে হয়েছে দু'খান! তাতে আবার খাবার জন্যেই দেয়া হচ্ছে প্লাস্টিকের চামচ। ঠোঁট গড়িয়ে চিবুকে যাতে না নামে সে জন্যেই পাওয়া যাচ্ছে স্ট্র। জীবন কতটা যে সহজ হয়েছে এবং হচ্ছে- বলার অপেক্ষা রাখেনা। সবকিছুকে ছাড়িয়ে এ যান্ত্রিকতা কি আসলেই সবার ভালো লাগবে? বিনোদন বলতেই কি ব্যালকনিতে রাখা বড় আদরে পেট আর চিড়িয়াখানার লোহার শিক কামড়ে ধরে বানর? আজ মনটা কেমন জানি বিষন্ন হয়ে উঠলো।